প্রকাশিত: Tue, Aug 15, 2023 10:49 PM
আপডেট: Thu, Jul 3, 2025 5:19 PM

[১]জনগণকে ‘শিক্ষা দেয়ার জন্য তালেবান যেভাবে প্রকাশ্যে শাস্তি দিচ্ছে

ইকবাল খান:  [২] ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর তালেবান সরকার যখন মধ্য আফগানিস্তানের তারিনকোট শহরের একটি ফুটবল স্টেডিয়ামে হাজার হাজার মানুষের সামনে ২২ ব্যক্তিকে বেত্রাঘাত করতে আনে, অনেকের সাথে ২১-বছর বয়সী আফগান জুম্মা খানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আমরা যার নাম বদলে দিয়েছে বিবিসি । সূত্র: বিবিসি বাংলা।

[৩] এই ২২ জন অভিযুক্তের মধ্যে দু’জন ছিলেন নারী এবং বিভিন্ন ‘অপরাধের’ জন্য এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর আগের দিন তালেবান কর্তৃপক্ষ পুরো শহর জুড়ে মসজিদ এবং রেডিও মারফত এই শাস্তিদানের কথা ঘোষণা করেছিল, এবং এ থেকে “শিক্ষা নেয়ার” জন্য লোকজনকে স্টেডিয়ামে হাজির থাকতে বলেছিল।

[৪] বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বড় বড় স্টেডিয়ামগুলিকে বেছে নেয়া হয়। 

[৫] তারিনকোট স্টেডিয়ামে এমনিতে স্থান হয় ১৮,০০০ দর্শকের, কিন্তু জুম্মা খান জানাচ্ছেন, আরও অনেক বেশি সংখ্যক লোক সেদিন উপস্থিত ছিল। তিনি বিবিসিকে বলেন, “অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্টেডিয়ামের মাঝখানে ঘাসের ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছিল।

[৬] দোররা মেরে সেদিন যাদের শাস্তি দেয়া হয়েছিল তালেবানের সুপ্রিম কোর্ট টুইটারের মাধ্যমে তাদের কথা, এবং শাস্তিপ্রাপ্তদের সংখ্যা ও লিঙ্গের বিষয়টি বিবিসি নিশ্চিত করেছে।

[৭] এনিয়ে বিবিসির সাথে কথা বলার সময় তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন: “শরিয়া আইনের অধীনে আমাদের নেতা এধরনের শাস্তি কার্যকর করতে বাধ্য। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, জনগণের উচিত এসব শাস্তিকে সামনে থেকে দেখা, যাতে তারা এসব থেকে শিক্ষা নিতে পারে। শরিয়া আইন অনুযায়ী এগুলোকে বাস্তবায়ন করা আমাদের দায়িত্ব।”

[৮] জুম্মা খান জানাচ্ছেন, অভিযুক্ত পুরুষদের বয়স ছিল ১৮ থেকে ৩৭ বছরের কোঠায়। এদের প্রত্যেককে ২৫ থেকে ৩৯টি দোররা মারা হয়। 

[৯] এধরনের শাস্তি বিদেশে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে একথা ভেবে তারা দৃশ্যত উদ্বিগ্ন। এজন্য তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা এসব ঘটনার ছবি তোলা বা ভিডিও রেকর্ড করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

[১০] কিন্তু জুম্মা খান গোপনে ঐ ঘটনার একটি ভিডিও বিবিসির কাছে পাঠিয়েছেন। অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীরাও ঐ দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করেছেন, যেগুলো দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়।

[১১] তালেবান সরকার ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে মানুষের শাস্তির কথা ঘোষণা করেছিল এবং সুপ্রিম কোর্ট এদের বিষয়ে বিবৃতি জারি শুরু করেছিল।

[১২] বিবিসির তদন্ত থেকে জানা যাচ্ছে, তারপর থেকে ৫০টি ঘটনায় মোট ৩৪৬ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। অভিযুক্তরা পুরুষ নাকি মহিলা, শীর্ষ আদালত তা প্রকাশ করেনি। তবে অন্তত ৫১টি মামলায় আসামী ছিল নারী এবং ২৩৩টি মামলায় আসামী পুরুষ ছিল বলে জানা যাচ্ছে। (৬০টি মামলায় অভিযুক্তদের ব্যাপারে তথ্য অজানা)।

[১৩] অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে - একজনকে দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তানের ফারাহ প্রদেশে এবং অন্যজনকে পূর্বাঞ্চলীয় লাঘমান প্রদেশে।

[১৪] গত বছর ১৩ নভেম্বরের পর থেকে প্রকাশ্যে শাস্তির মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যায়, যখন তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্তদের মামলাগুলি “সতর্কতার সাথে” পর্যবেক্ষণ করতে এবং অভিযুক্তদের ওপর “আইন প্রয়োগ করার” জন্য সে দেশের বিচার বিভাগকে নির্দেশ দেন।

[১৫] তালেবান সরকার জানাচ্ছে, আফগানিস্তানের ইসলামিক বিচার ব্যবস্থা অনুযায়ী তারা এ ধরনের শাস্তি প্রদান করে, যেটা শরিয়া আইনের চরম ব্যাখ্যা। চুরি, খুন, ব্যভিচার, পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক, “বেআইনি যৌন সম্পর্ক”, দুর্নীতি, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া, খুন, অনৈতিকতা ইত্যাদি মিলিয়ে ১৯টি শ্রেণিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ রয়েছে।

[১৬] তবে মানবাধিকার আন্দোলনকারী এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সাতটি ঘটনা।

[১৭] তারা মনে করেন, এই শাস্তির লক্ষ্য হবেন দুর্বল নারী যারা ইতোমধ্যেই সম্ভবত পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন কিংবা জোরপূর্বক/অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ের শিকার হয়েছেন।

[১৮] সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে “লিওয়াতাত”-এর ছয়টি ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে। আফগান শরিয়া আইনে দুই পুরুষের মধ্যে যৌন মিলনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

[১৯] জাতিসংঘ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং বিশ্বের বহু দেশ এসব ঘটনা বন্ধের জন্য তালেবানদের প্রতি আহ্বান জানালেও তালেবানের নীতিতে পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

[২০] সরকারি বিবৃতিতে তারা শুধু বলে যে প্রকাশ্যে শাস্তি কার্যকর করা হলে জনগণ তা থেকে “শিক্ষা নিতে” পারে।

[২১] তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বিবিসিকে বলেছেন, “মানুষের মানসিক সুস্থতার বিষয়টা আল্লাহ দেখবেন। আমরা শরিয়া আইনের বিরুদ্ধে যেতে পারি না।“